উনবিংশ শতকের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কারগুলোর একটি হলো ক্যামেরা, যা বাস্তবের কোনো মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দি করে রাখতে পারে। এর ফলে মানবসভ্যতার অর্জনের মুকুটে এক নতুন পালক যোগ হয়, এবং মানুষ চাইলেই তাদের পছন্দের মুহূর্তগুলোর স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখতে সমর্থ হয়।
১৮২০ এর দশকের শেষ ভাগে ক্যামেরায় প্রথম মানুষের ছবি তোলা হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, শুরুর দিকে ক্যামেরায় মানুষের যেসব ছবি তোলা হতো, সেগুলোর মধ্যে একটি পরিচিত সাদৃশ্য বিদ্যমান ছিল। সেটি হলো, ছবিতে মানুষকে সচরাচর হাসতে দেখা যেত না। এখন যে আমরা ক্যামেরায় ছবি তুলতে গেলেই হাসতে শুরু করি, এ প্রবণতার সূচনা ঘটেছে অনেক পরে, ১৯২০ ও ‘৩০ এর দশকে।
যেমন দেখুন ১৯০০ সালের দিকে তোলা এই ওয়েডিং গ্রুপ ফটোটি। বিয়ে একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিনগুলোর একটি। অথচ এ ছবিতে যারা রয়েছে, সবাই মুখখানা এমন করে রেখেছে যেন তাদেরকে কেউ জোর করে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, কিংবা তারা কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে নয়, এসেছে কারো শেষকৃত্যানুষ্ঠানে।

ওয়েডিং ফটোতেও মুখ গোমড়া সকলের; Image Source: Getty Images
এখন আমাদের প্রশ্ন হলো, কেন অতীতে মানুষ ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে (বা বসে) হাসত না? কেন তারা মুখটা গম্ভীর করে রাখত? এ প্রশ্নের উত্তরে বেশ কিছু সম্ভাব্য তত্ত্ব বের করা হয়েছে। চলুন জেনে নিই সেগুলো কী কী।
প্রাথমিক প্রযুক্তি হাসির উপযোগী ছিল না
একটি সাধারণ ব্যাখ্যা হতে পারে এই যে, শুরুর দিকে ক্যামেরায় ছবি তোলার জন্য অনেক বেশি সময় লাগত। এত লম্বা সময় ধরে কারো পক্ষে মুখ হাসি হাসি করে রাখা সম্ভব ছিল না। আর কেউ যদি শুরু থেকে মুখ হাসি হাসি করে রাখেও, একদম শেষ মুহূর্তে যে তার মুখ নড়ে উঠবে না বা হাসি ম্লান হবে না, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর এমনটি হলে ছবিটি ঝাপসা বা অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ চেষ্টা করত যথাসম্ভব স্থির থাকার, যাতে করে তার ছবিটি ঠিক থাকে।

ছবির মাঝখানটা ফেটে গেছে; Image Source: Getty Images
উপরের এই ছবিটি থেকে আমরা বুঝতে পারি, কেন শুরুর দিককার ক্যামেরাগুলো হাসিমুখ বন্দি করার জন্য দুরূহ ছিল। ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন, ছবিটির মাঝামাঝি জায়গাটা ভেঙে গেছে। এর কারণ হয়তো এই যে, মাঝখানের কোনো একজন ব্যক্তি হয়তো শেষ মুহূর্তে সামান্য নড়ে উঠেছিলেন।
শুরুর দিকের ফটোগ্রাফগুলো চিত্রকর্ম দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত ছিল
প্রথম প্রথম যখন ক্যামেরার প্রচলন ঘটল, তখনও অনেক মানুষই বুঝতে পারেনি সাধারণ পোর্ট্রেইট চিত্রকর্মের সাথে এর ফারাক কী। তাদের কাছে দুইটিই ছিল অভিন্ন বিষয়, স্রেফ হয়তো ফরম্যাট কিছুটা আলাদা। তাই তো কোনো পোর্ট্রেইটের জন্য তারা যেভাবে গুরুগম্ভীর মুখে পোজ দিত, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েও ঠিক সেভাবেই পোজ দিত। আর সে কারণেই তাদের মুখে হাসির চিহ্নমাত্রও দেখা যেত না।

চার বছরের শিশুর মুখেও হাসি নেই; Image Source: Getty Images
শুধু সাধারণ মানুষই নয়, এমনকি পেশাদার মডেলদের চিন্তাভাবনাও ঠিক এমনই ছিল। যেমন ১৮৯৪ সালে ফটোগ্রাফিক জার্নাল অব আমেরিকা এলমার এলসওয়ার্থ মাস্টারম্যান নামক মডেলের সাক্ষাৎকার নেয়। তিনি সাধারণত চিত্রকর্ম কিংবা ফটোগ্রাফে যীশু খ্রিস্টের ছবির মডেল হতেন। তিনিও চিত্রকর্ম ও ফটোগ্রাফকে আলাদা দুইটি শিল্পমাধ্যম বলে মনে করতেন না। তাই সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকেই তিনি পালটা প্রশ্ন করেছিলেন, “একটি ফটোগ্রাফের জন্য পোজ দেয়া আর একটি চিত্রকর্মের জন্য পোজ দেয়ার মধ্যে তফাতটা কী?”
প্রাথমিক ফটোগ্রাফকে দেখা হতো অমরত্ব লাভের সিঁড়ি হিসেবে
বর্তমানে আমরা যখন কোনো প্রোফাইল পিকচারের জন্য ছবি তুলি, আমাদের লক্ষ্য থাকে নিজেদের “কুল” দেখানো, এবং একই সাথে ছবিটি যেন বর্তমান আনন্দময় সময়টিকে ধরে রাখতে পারে। কিন্তু শুরুর দিকে মানুষজন তাদের ফেসবুকে দেয়ার কথা চিন্তা করে ছবি তুলত না। তাদের কাছে ফটোগ্রাফ ছিল অমরত্ব লাভের একটি সিঁড়ি।
একটু সহজ করে বলা যাক। এখন যেমন আমরা এক মিনিটেই চাইলে দশ থেকে পনেরোটি ছবি তুলে ফেলতে পারি, তখনকার দিনে বিষয়টি তেমন ছিল না। ফটোগ্রাফি এতটাই বিরল ছিল যে, অনেকেই হয়তো তার সারাজীবনে একটি ছবিই তুলত। তাই তার মনে এ বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবেই খেলা করত যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমার অস্তিত্বের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে এই একটি ছবিই। এবং আপনি যখন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কোনো কাজ করবেন, নিঃসন্দেহে সেটির গুরুত্ব আপনার কাছে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। তৎকালীন মানুষদের ক্ষেত্রেও তেমনটিই হতো। তারা যখনই চিন্তা করত তাদের নাতিপুতি এই ছবি দেখে তাদের চিনবে, তখন হাসি-হাসি মুখ করে ছবিটিকে খেলো করা নয়, বরং গুরুগম্ভীর মুখে নিজের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলাকেই তারা অধিক কাম্য বলে মনে করত।

মার্ক টোয়েইনও ক্যামেরার সামনে পোজ দিতেন এভাবে; Image Source: Topical Press Agency/Getty Images
এমনকি লেখক মার্ক টোয়েইন, যিনি নিজে অসংখ্য রম্য রচনার মাধ্যমে মহাকালের পাতায় নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন, তিনিও মনে করতেন ফটোগ্রাফিতে হাসা কোনোভাবেই উচিৎ নয়। তাই তো তিনি বলেছিলেন, “আমি মনে করি একজনের জীবনে ফটোগ্রাফি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। তাই বোকার মতো হেসে ফেলে ছবিটিকে চিরদিনের জন্য হাস্যকর করে তোলার কোনো মানেই হয় না।”
ভিক্টোরিয়ান ও এডওয়ার্ডিয়ান সংস্কৃতিতে হাসিকে ভালো চোখে দেখা হতো না
চতুর্থ যুক্তিটি হতে পারে সবচেয়ে শক্তিশালী যে কেন আগেকার দিনে মানুষ ছবি তোলার সময় হাসত না। কিন্তু একই সাথে এটি প্রমাণ করা সবচেয়ে কঠিনও বটে। তারপরও আমরা তর্কের খাতিরে অনুমান করতেই পারি, বিংশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত মানুষ মনে করত হাসি বুঝি কেবল বোকাদের জন্যই।

না হেসে তারা প্রমাণ করছে যে তারা বোকা নয়; Image Source: Stapleton Collection/Corbis
পাবলিক ডোমেইন রিভিউয়ের জন্য নিকোলাস জিভস নামের একজন গবেষক একটি জরিপ করেন। অসংখ্য পোর্ট্রেইট খতিয়ে দেখে তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, শত শত বছর ধরে মানুষ হাসিকে খাটো করেই দেখত। ফটোগ্রাফে মানুষের না হাসার পেছনে আরো একটি বিকল্প সম্ভাব্যতাও রয়েছে যে তখনকার দিনে মানুষের দাঁত হয়তো ভালো ছিল না। কিন্তু এ সম্ভাবনাকে জিভস নাকচ করে দিয়েছেন। কারণ তার মতে, প্রায় সব ছবিতেই তো মানুষ ঠোঁট বন্ধ করে রেখেছে। তার মানে কি তখনকার দিনে সকলের দাঁতেই সমস্যা ছিল? তা-ই যদি হয়ে থাকে, তাহলে তো বিষয়টি আদতে কোনো সমস্যাই ছিল না!
শেষ কথা
তবে ভিক্টোরিয়ান যুগেই কেউই ছবিতে হাসত না, এটি একটু বেশিই সাধারণীকরণ হয়ে যাবে। কারণ ফ্লিকারে “স্মাইলিং ভিক্টোরিয়ান্স” নামক একটি গ্রুপে প্রায় ২,১০০ ছবির সংগ্রহ রয়েছে, এবং সেখানে কিছু কিছু ছবিতে প্রকৃতপক্ষেই মানুষকে হাসতে দেখা যাচ্ছে। সুতরাং আগেকার দিনে ছবি তোলার সময় মানুষের না হাসার পেছনে যে কারণই থাকুক না কেন, অবশ্যই তা সবার বেলায় প্রযোজ্য নয়।

১৯০৪ সালে তোলা এ ছবিটিতে কিন্তু মানুষটি হাসছে; Image Source: Laufer/American Museum of Natural History Library, Image #336609
Comments
0 comments