পৃথিবীর বুকে মানবসভ্যতার চেহারা কিন্তু সবসময়ই এমন ছিল না, যেমন আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন। একটা লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে মানুষ হিসেবে আমরা আজকের এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, এবং এক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ সাহায্য করেছে অসাধারণ সব উদ্ভাবন। যুগে যুগে মানুষ এমন সব বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক উদ্ভাবন ঘটিয়েছে, যা পাল্টে দিয়েছে মানবসভ্যতার ইতিহাস। চলুন, জেনে নিই মানবসভ্যতার ইতিহাস পাল্টে দেয়া তেমনই ১০টি উদ্ভাবন সম্পর্কে।
বাষ্প ইঞ্জিন

বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন জেমস ওয়াট; Image Source: Famous Inventors
যদিও বাষ্প ইঞ্জিনের একদম প্রাথমিক সংস্করণের দেখা মেলে সেই তৃতীয় শতক থেকেই, কিন্তু এর প্রকৃত বিকাশ ঘটে আসলে উনবিংশ শতকে এসে। শিল্প বিপ্লব এক্ষেত্রে রেখেছে একটি বিশাল অবদান। বহু দশক প্রচেষ্টার পর উদ্ভব ঘটেছে আধুনিক বাষ্প ইঞ্জিন তথা কমবাস্টন ইঞ্জিনের, আর তা বাস্তবায়িত হয়েছে জেমস ওয়াটের হাত ধরে। এ ইঞ্জিনের কল্যাণেই পরবর্তীতে আরো অসংখ্য যন্ত্র, যেমন অটোমোবাইল, উড়োজাহাজ প্রভৃতির উদ্ভব ঘটেছে, যা পাল্টে দিয়েছে বর্তমান পৃথিবীর চেহারা।
চাকা

মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার চাকা; Image Source: Famous Inventors
একটি অক্ষকে কেন্দ্র করে গোলাকার কিছু ঘুরবে এবং কম শক্তি প্রয়োগ করে বেশি ভারি জিনিসকে বহন করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এ ধারণা ও তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটে চলেছে সেই প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার যুগ থেকে। এছাড়াও প্রাচীন মিশর ও ইউরোপেও দেখা গেছে এর পৃথক পৃথক রূপ। তাই নিশ্চিত করে বলা কঠিন যে আসলেই কোথায় প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছে চাকা। তবে মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দ থেকেই প্রাচীন মানুষ ব্যবহার শুরু করেছে চাকার। এটিকে অনেকেই অভিহিত করে থাকেন মানবসভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হিসেবে, কেননা এর মাধ্যমেই যাতায়াত থেকে শুরু করে কৃষিকাজ, সব কিছুতে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে।
ছাপাখানা

আধুনিক ছাপাখানার জনক জোহানেস গুতেনবার্গ; Image Source: Famous Inventors
১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে ছাপাখানার উদ্ভাবন করেন জোহানেস গুতেনবার্গ। এ কাজের অনেকটাই তিনি ধার করেন চীনাদের অভিজ্ঞতা থেকে, এবং সেগুলোর আরো বাস্তবসম্মত প্রয়োগ ঘটান ইউরোপীয় আধুনিক যন্ত্রে। তবে উনবিংশ শতকে কাঠের উপকরণের বদলে ইস্পাতের উকরণ ব্যবহারের ফলে ছাপাখানার সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি ঘটে। ইউরোপীয় মানুষদের তাদের অর্জিত জ্ঞান দিকে দিকে ছড়িয়ে দেয়া থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক ও শিল্প বিপ্লব, এগুলো কোনোভাবেই সম্ভবপর ছিল না ছাপাখানা ব্যতীত। ১৫০০ সালের মধ্যেই পশ্চিমা ইউরোপে ছাপার পরিমাণ স্পর্শ করেছিল ২০ মিলিয়ন।
কম্পিউটার

কম্পিউটারের জনক চার্লস ব্যাবেজ; Image Source: Famous Inventors
আধুনিক কম্পিউটারের মূল ভাবনা ও ধারণা প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল অ্যালান টুরিংয়ের মুখ থেকে। তবে এরও আগে প্রথম যান্ত্রিক কম্পিউটারের উদ্ভব ঘটে উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে। এ উদ্ভাবন প্রকৃতপক্ষেই মানবসভ্যতার ইতিহাসকে এক ধাক্কায় অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে, এবং অবিশ্বাস্য সব অর্জনের সম্মুখীন করেছে। উচ্চ ক্ষমতার সামরিক বিমানকে আকাশে ওড়ানো থেকে শুরু করে মহাশূন্যে মানবসৃষ্ট মহাকাশযান প্রেরণ, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি ও মৃত্যুভয়কে অনেকটাই জয় করে, ভিজ্যুয়াল ইমেজারি তৈরি করা, প্রচুর পরিমাণ তথ্যকে সংরক্ষণ করে রাখা কিংবা গাড়ি, ফোন ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করা – সবই কোনো না কোনোভাবে পরিচালিত হচ্ছে কম্পিউটারের মাধ্যমেই।
ইন্টারনেট

ইন্টারনেট আবিষ্কারের কৃতিত্ব ভিন্টন সার্ফের; Image Source: Famous Inventors
প্রথম ইন্টারনেটের বিকাশ ঘটে ১৯৭৩ সালে, ভিন্টন সার্ফের হাত ধরে। তিনি এ কাজে সাহায্য পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি থেকে। এর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন গবেষণাগার এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের একটি রাস্তা তৈরি করা। কিন্তু ধীরে ধীরে এর ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। ইন্টারনেট ও ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের উদ্ভাবনকে বলা হয়ে থাকে বিংশ শতকের সবচেয়ে বৈপ্লবিক আবিষ্কার। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১৮০টি দেশে ২৫ মিলিয়ন কম্পিউটার পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে যায় ইন্টারনেটের বদৌলতে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব

ইন্টারনেট আবিষ্কার করেন টিম বার্নার্স লি; Image Source: Famous Inventors
আমরা আজ যে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবকে চিনি, সেটির ভবিষ্যদ্বাণী প্রথম করেছিলেন আর্থার ক্লার্ক। তিনি লিখেছিলেন স্যাটেলাইট এক সময় নাকি যাবতীয় জ্ঞান থাকবে বিশ্ববাসীর আঙ্গুলের ছোঁয়ার দূরত্বে। একীভূত হবে টেলিফোন, ফটোকপিয়ার, টেলিভিশন এবং কম্পিউটার। তবে তার এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য বলে প্রমাণিত হতে সময় লেগেছিল ১৯ বছর। ১৯৮৯ সালে সিইআরএন-এর একজন কর্মচারী, টিম বার্নার্স লি প্রথম ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আবিষ্কার করেন। এখন পর্যন্ত মানুষের অর্জিত প্রায় সকল জ্ঞানকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এসেছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব, এবং যে কেউ চাইলেই সেগুলো জেনে নিয়ে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনকে করে তুলতে পারছে আরো আলোকিত ও ঝলমলে।
টেলিভিশন

আধুনিক টেলিভিশন আবিষ্কারের কৃতিত্ব ভ্লাদিমির কসমা জোয়ারিকিন এবং ফিলো ফার্নসওয়ার্থের; Image Source: Famous Inventors
যদিও টেলিভিশন আবিষ্কারের কৃতিত্ব কোনো একক ব্যক্তির উপর ন্যাস্ত করা সম্ভব নয়, তবে অনেকেই মনে করেন যে আধুনিক টেলিভিশন আসলে দুইজন ব্যক্তির উদ্ভাবন: ভ্লাদিমির কসমা জোয়ারিকিন (১৯২৩) এবং ফিলো ফার্নসওয়ার্থ (১৯২৭)। টেলিভিশন একটি অসামান্য উদ্ভাবন যা যান্ত্রিক থেকে শুরু হয়ে এক পর্যায়ে বৈদ্যুতিক, এবং বর্তমানে ডিজিটাল, স্মার্ট ও থ্রিডি রূপ লাভ করেছে। যদিও এখন স্মার্টফোনের আগ্রাসনে মানুষের টেলিভিশন দেখার প্রবণতা কমে গেছে, তবে গত দশকেও একজন গড়পড়তা মানুষ দিনের ৪ থেকে ৮ ঘণ্টা টিভি দেখত, এবং এটি ছিল পারিবারিক বিনোদনের সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ।
বৈদ্যুতিক বাতি

বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেন টমাস আলভা এডিসন; Image Source: Famous Inventors
পুরো উনবিংশ শতক জুড়ে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের লক্ষ্যে কাজ করে চলেন বিজ্ঞানীরা, যদিও এর প্রধান কৃতিত্ব দেয়া হয় টমাস আলভা এডিসনকে। তিনিই ১৯৭৯ সালে প্রথম এমন একটি বাতির উদ্ভব ঘটান, যা পুড়ে না গিয়ে ১৫০০ ঘণ্টা জ্বলতে সক্ষম। তার এ আবিষ্কার ও ধারণাকে পরবর্তীতে এগিয়ে নিয়ে যান আরো অনেকে, এবং তাদের সামগ্রিক অবদানের ফলেই আজ আমাদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে জ্বলছে ঝলমলে বাতি।
পেনিসিলিন

পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং; Image Source: Famous Inventors
১৯২৮ সালে দুর্ঘটনাক্রমে ব্যাকটেরিয়ায় পরিপূর্ণ একটি পেত্রির থালায় পেনিসিলিন আবিষ্কার করে বসেন নোবেল বিজয়ী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। পেনিসিলিন ওষুধ হলো মূলত এক দল অ্যান্টিবায়োটিক, যা মানবশরীরের বিভিন্ন সংক্রামক অসুখকে সারাতে সক্ষম, তা-ও আবার ওই মানবশরীরকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পেনিসিলিনের ব্যবহার খুব বেশি মাত্রায় বেড়ে যায়, এবং এর কল্যাণেই বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করা থেকে আটকানো সম্ভব হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিখ্যাত (যদি সেরা না-ও হয়) আবিষ্কার এটিই।
টেলিফোন

টেলিফোন আবিষ্কার করেন আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল; Image Source: Famous Inventors
১৮৭৬ সালে আলেকজান্ডার গ্রাহান বেল দুইটি কাপকে একটি সূতা দিয়ে জোড়া লাগান, এবং একটিতে কথা বলে অন্যটি দিয়ে শোনার চেষ্টা করেন। এভাবেই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় টেলিফোন আবিষ্কারের চিন্তার। পরবর্তীতে বেল সত্যিকারের টেলিফোন আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ একে অপরের সাথে কথা বলতে সক্ষম হয়। এই অসামান্য আবিষ্কারটিই সময়ের প্রভাবে উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উচ্চতায় এসে পৌঁছেছে, এবং এখন প্রত্যেকের পকেটে পকেটে ঘুরছে মোবাইল ফোন, যা কিনা টেলিফোনেরই উন্নততর সংস্করণ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এটিও শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কারগুলোর একটি, যার ফলে পারস্পরিক যোগাযোগ আজ অতি সহজ একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
Comments
0 comments