কোনো দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ সে দেশের তরুণ ছাত্রসমাজ। দেশের উন্নয়নের যাত্রায় তরুণেরা প্রধান চালিকাশক্তি, আবার দেশের সকল অসংগতিতে প্রতিবাদের প্রধান কণ্ঠস্বর তরুণেরাই। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে পুরো দেশের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে তরুণ ছাত্রেরা।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছুদিন পরপরই বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্ররা সোচ্চার হয়ে আন্দোলন করছে। সেসব আন্দোলনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন দেশের ছাত্রসমাজ চাইলে যে কতৃপক্ষের সর্বোচ্চ ক্ষমতার ভিত বদলে দিতে পারে সে প্রমাণ আমাদের ইতিহাসের নিকট অতীতেই দেখতে পাই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা অপরিসীম। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে গণ অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সকল ক্ষেত্রেই ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণ ছিল সর্বোচ্চ। বিশেষত ষাটের দশকে স্বৈরাচার আইয়ুব খানের শাসনামলে ধারাবাহিক ছাত্র আন্দোলন এদেশের সংগ্রামের ইতিহাসের এক শক্তিশালী অধ্যায়।
১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার কিছুদিন পর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে নিজেই প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে অনেকের নিকট দয়ালু শাসক আখ্যা পাওয়া আইয়ুবের মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানসসহ কম শক্তিশালী অঞ্চল সমূহের অধিকারহরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের, বিশেষ করে সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চলের সমৃদ্ধিসাধন। এ উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণদের নানারূপে অত্যাচার ও বঞ্চিত করা হয়। তৎকাকালীন ছাত্র সমাজ এই অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আন্দোলন শুরু করে।

জুলফিকার আলি ভুট্টোর সাথে আইয়ুব খান; Image Source: Wikimedia Commons
শিক্ষা আন্দোলন
আইয়ুব খানের শোষণ নীতির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম আন্দোলন শুরু হয় শিক্ষাখাত নিয়ে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এর দুই অংশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যপক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। পাকিস্তানি শাসকদের পরিকল্পনা ছিল পূর্ব অঞ্চলে শিক্ষার অগ্রগতি রোধ করে তরুণ সমাজের জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ বন্ধ করা ও শোষণমূলক রাজনীতি বজায় রাখা।
১৯৪৭-৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মোট প্রাথমিক স্কুল, ওই সমস্ত স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর শতকরা হার ছিল যথাক্রমে ৭৭.৮৯%, ৮০.৯৩% এবং ৭৮.৭৯%। ষাটের দশকের শুরুতে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৮.৯৩%, ৫৭.৬৮% ও ৬৩.৫৪%। আবার মাধ্যমিক স্তরে ১৯৪৭-৪৮ সালে স্কুল, শিক্ষক ও পাঠরত শিক্ষার্থীর হার যথাক্রমে ৫৭.২৬%, ৫৬.৩৮% ও ৫০.৪৭% ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু ষাটের দশকের শুরুতে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৮.৫০%, ৩৯.৭৪% এবং ৩৭.৪৫%-এ। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেও দেশের দুই অংশে এই বৈষম্যনীতি প্রকট ছিল।
আইয়ুব শাসনের রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ ও শিক্ষাক্ষেত্রে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে। ছাত্রদের আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে ১৯৬১ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি ও রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আয়োজন করা হয় ৪ দিন ব্যাপি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন; Image Source: somewhereinblog.net
১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীরর মুক্তির দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল ,ধর্মঘট পালন করে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমাবেশ করে। এ ধর্মঘটের সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত না হওয়ায় পরদিন ২ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা মিছিল করে প্রেসক্লাবে যায় এবং সরকারি সংবাদপত্রে অগ্নিসংযোগ করে প্রতিবাদ জানায়। চলতে থাকে আইয়ুব বিরোধী প্রচারণা ও আন্দোলন। অবস্থা বেগতিক দেখে ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষিত হয়। ছাত্ররা তবুও হল ছেড়ে না গেলে ৮ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘেরাও করে ছাত্রদের হল থেকে বের করে দেয় এবং ছাত্র নেতাদের গ্রেফতার করা হয়।
একই সালে আইয়ুব খান প্রবর্তিত শরীফ কমিশন অনুযায়ী পাকিস্তানের শিক্ষা নীতি ঘোষণা করা হয়। এ অনুযায়ী –
- প্রতিটি স্কুলের ৬০ শতাংশ ব্যয় শিক্ষার্থীদের বেতন থেকে নেওয়া হবে ও ২০ শতাংশ ব্যবস্থাপনা কতৃপক্ষ নির্বাহ করবে।
- পাস কোর্স ও অনার্স কোর্সের সময়গত পার্থক্য বিলোপ করা হবে।
১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা এ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে মিছিল বের করলে এতে গুলি চালায় পুলিশ। এতে নিহত হয় বাবুল, মোস্তফা,ওয়াজিউল্লাহ।

১৯৬৫ সালে সংঘটিত হয় পাক-ভারত যুদ্ধ; Image Source: Wikimedia Commons
৬৫ এর পাক-ভারত যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা
১৯৬২-৬৫ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্র আন্দোলন ব্যপক রূপ নিতে থাকে। ১৯৬৫ সালে ১৭ দিন ব্যাপী পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব বাংলার প্রতি শাসক গোষ্ঠীর অবহেলা ও বৈষম্য তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হয়। যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার নিরাপত্তা পুরোপুরি অরক্ষিত রাখা হয়। ভারত চাইলেই তখন সে প্রদেশ দখল করে নিতে পারত।
যুদ্ধের কারণে সমগ্র বিশ্বের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যায় অনেক। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পাচার করে পশ্চিম পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পায়। বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানি রীতির আগ্রাসন চালানো হয়। এসব অনাচারের বিরুদ্ধে বাংলার তরুণ সমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
পাক-ভারত যুদ্ধের পরিস্থিতিতে প্রভাবিত হয়ে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবর রহমান প্রদেশভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে ৬ দফা দাবী পেশ করেন।

৬ দফা দাবি ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ; Image Source: Kaler Kantho
ছয় দফা প্রস্তাব পেশ ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা ও শোষণ থেকে মুক্ত করতে ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ছয় দফা প্রস্তাব ঘোষণা করেন শেখ মুজিব । এ প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও এ অঞ্চলের স্থায়ী নিরাপত্তার স্বার্থে আধাসামরিক বাহিনী গঠনের দাবী জানানো হয়। ৭ জুন ছয় দফা প্রস্তাব বাস্তবায়নের দাবীতে হরতাল পালন করা হয়। ছয় দফাকে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করে সারাদেশে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়।
পাকিস্তানি শাসকেরা ছয় দফাকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার প্রচারণা হিসেবে চিহ্নিত করে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও অপর ৩৪ জনের বিরুদ্ধে “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য” শিরোনামে মামলা দায়ের করে যা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবেই সার্বজনীন পরিচিত।
ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় নিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিব ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার করা হয় ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার শুরু করা হয়।
নভেম্বর মাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ অন্যান্য রাজ বন্দীদের মুক্তির দাবীতে গণ আন্দোলনের শুরু হয়। এ আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়ে উঠে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে। ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা “ছাত্র সংগ্রাম কমিটি” গঠন করে ১১ দফা দাবী পেশ করে। ১১ দফায় শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ছয় দফা দাবীর পাশাপাশি ছাত্র অধিকার, কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থ সংক্রান্ত দাবীসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকে। কর্তৃপক্ষের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করতে থাকে ছাত্র সমাজ। ২০ জানুয়ারি ধর্মঘট ও মিছিল পালনকালে এক পুলিশ অফিসারের গুলিতে নিহত হন ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান। আসাদের মৃত্যুতে আন্দোলন আরো তীব্র গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ২১ জানুয়ারি থেকে লাগাতার হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল চলতে থাকে। ২৪ জানুয়ারি মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে রুস্তম ও মতিউর নামে দুই ছাত্র শহীদ হন। ক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা শহর। সেদিন পল্টন ময়দানে দুই শহীদের লাশের পাশে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। শহরে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও কারিফিউ জারি করা হলে কারফিউ ভেঙ্গেই বিক্ষোভ চলতে থাকে। সারাদেশের পাড়া মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। প্রতদিন চলছিল মিছিল আর বাড়ছিল শহীদের সংখ্যা।

সারাদেশের পাড়া মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে গণঅভ্যুত্থান; Image Source: Wikimedia Commons
আইয়ুবের পতন
আন্দোলনের জোয়ার নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের সাথে সমঝোতার লক্ষ্যে ৬ ফেব্রুয়ারি এক সপ্তাহের সফরে ঢাকা আসেন আইয়ুব খান। এরই মাঝে ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে ১১ দফা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য শপথ গ্রহণ করা হয়। আইয়ুব খান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনা প্রস্তাব করলেও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানান।
অপরদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি এ মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা।
দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের চাপে, গণদাবীর মুখে ২২ ফেব্রুয়ারি মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য অভিযুক্তদের নিঃশর্ত মুক্তিদানে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রেসকোর্স ময়দানের গণসংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি দেওয়া হয়।

রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি দেয়া হয়; Image Source: Bangla Tribune
পূর্ব বাংলার মানুষের বিক্ষোভ, প্রতিবাদের গণ জোয়ার দেখে নমনীয় নীতি অনুসরণে বাধ্য হন আইয়ুব খান। ২৬ মার্চ থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত কয়েকদফা গোলটেবিল বৈঠকের পর সংসদীয় নির্বাচন সংক্রান্ত দাবীর প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করেন তিনি। অবশেষে ২৫ শে মার্চ পদত্যাগ করে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন আইয়ুব খান। দীর্ঘ ১১ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলের পতন ঘটে।
Comments
0 comments