গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে ক্রিকেট খেলার তুমুল জনপ্রিয়তা। এই মুহূর্তে ক্রিকেট বিশ্বকাপের উন্মাদনায় বিশ্বের এ অঞ্চল আবেগে থরথর করছে তো বটেই, এমনকি আইপিএলের মতো ঘরোয়া প্রতিযোগিতা চলাকালীনও সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এ খেলাটি। এছাড়া ফুটবল নিয়েও এ অঞ্চলের মানুষের রয়েছে দারুণ আগ্রহ। ফুটবল বিশ্বকাপ কিংবা ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবল দেখার জন্য নির্ঘুম রাত কাটায় লক্ষ লক্ষ মানুষ।
অথচ মজার ব্যাপার হলো, এই যে ক্রিকেট ও ফুটবল নামের অসম্ভব জনপ্রিয় দুইটি খেলা, এ দুটির কোনোটিরই কিন্তু উৎপত্তি ভারতীয় মহাদেশে নয়। দুইটি খেলাই এখানে এসেছে ইংল্যান্ড থেকে, আর জনপ্রিয়তা তুঙ্গস্পর্শী হয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশিকদের কল্যাণে।
তবে এমন কিছু খেলাও রয়েছে, যেগুলো এ মুহূর্তে ভারতবর্ষে জনপ্রিয়তার শীর্ষে না থাকলেও, বৈশ্বিক অঙ্গনে সেগুলোর বেশ ভালো রকম গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে; এবং সে খেলাগুলোর জন্মও হয়েছে এ অঞ্চলেই। চলুন জেনে নেয়া যাক বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো তেমনই কিছু খেলার ব্যাপারে, যেগুলোর পথ চলার সূচনা হয়েছিল ভারতবর্ষেই।
দাবা

দাবা; Image Source: Shutterstock
দাবা খেলার জন্ম আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে, এবং এ খেলার একদম শুরুর দিককার, আধুনিক সংস্করণের নিদর্শন পাওয়া যায় ভারতেই। “চতুরঙ্গ” নাম ছিল খেলাটির, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় “চার অঙ্গবিশিষ্ট সেনাবাহিনী”। সেনাবাহিনীর এ চার অঙ্গ বা বিভাগ হলো হস্তি, অশ্ব, রথ ও পদাতিক। সেই ষষ্ঠ শতকে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালেই ভারতবর্ষে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল খেলাটি।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায় যে, সেই সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল থেকেই এ অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল দাবা সদৃশ “বোর্ড গেম”। এছাড়া আরেকটি তত্ত্ব বলছে, খেলাটিকে ডাকা হতো “অষ্টপদ” নামে, সংস্কৃত ভাষায় যার অর্থ মাকড়সা। পারস্য ও আরব পর্যটকদের মাধ্যমে এ খেলাটি প্রাচীন ভারতের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।
পোলো

পোলো; Image Source: Wallpaper Cave
ঘোড়ার পিঠে চড়ে খেলা হয় পোলো। মোট দুটি দল থাকে। প্রতি দলে খেলোয়াড় সংখ্যা চার করে। এটি এক সময় রাজাদের খেলা হিসাবে পরিচিত ছিল। ঘাসের মাঠে একটি ছোট শক্ত বল আঘাত করার জন্য লম্বা হ্যান্ডলড কাঠের মাল্টা ব্যবহার করে গোলপোস্টের ভেতরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্দেশে এ খেলাটি পরিচালিত হয়।
আধুনিক পোলোর জন্ম ও বিকাশ মণিপুরে। ১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ও চা বাগানের মালিকদের হাত ধরে শিলচর পোলো ক্লাব গঠিত হয়। মূলত জো শেরার নামে এক লেফটেন্যান্ট স্থানীয়দের এ খেলাটি খেলতে দেখেছিলেন, এবং তিনিই প্রথম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ব্রিটিশদেরও এ খেলাটি শিখতে হবে।
ভারতবর্ষ থেকে পোলো প্রথমে মাল্টায় ১৮৬৮ সালে, ইংল্যান্ডে ১৮৬৯ সালে, আয়ারল্যান্ডে ১৮৭০ সালে, আর্জেন্টিনায় ১৮৭২ সালে, এবং ১৮৭৪ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাদামাটা একটি খেলা থাকলেও, বিবর্তনের মাধ্যমে খেলাটি আরো সংগঠিত ও দক্ষতা নির্ভর একটি খেলায় রূপান্তরিত হয়।
এখন পোল একটি আন্তর্জাতিক খেলা, যা পৃথিবীর প্রায় সকল প্রান্তে, আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত খেলা হয়ে থাকে। আমেরিকায় ইউনাইটেড স্টেটস পোলো অ্যাসোসিয়েশনের তত্ত্বাবধায়নে রয়েছে খেলাটি। ১৯০০ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এটি অলিম্পিকেরও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কাবাডি

কাবাডি; Image Source: Star Sports
১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকসের একটি শৃঙ্খলা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কাবাডি। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন কাঠামো ও নিয়মে খেলাটি পরিচালিত হতো। বিশেষ করে পাঞ্জাবে এটি খুবই খ্যাতি লাভ করে, এবং তাদের সামরিক ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়।
বর্তমানে এটি হাডুডু নামে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা। এছাড়াও এটি ভারতের কর্ণটক, কেরালা, অন্ধ্র প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, বিহার, হরিয়ানা, তামিল নাড়ু, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব ও তেলেঙ্গানা রাজ্যেরও প্রধান খেলা।
১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া কাবাডি ফেডারেশন। তারা এ খেলাটির জন্য কিছু আনুষ্ঠানিক নিয়মকানুন প্রণয়ন করে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তাদের সৃষ্ট বেশ কিছু নিয়মই অনুসরণ করা হয়।
ব্যাডমিন্টন

ব্যাডমিন্টন; Image Source: Wallpaper Cave
এই খেলাটির উৎপত্তি ঘটেছে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলে, যখন ইংরেজ সাহেবরা পুনের গ্যারিসন টাউনে এই খেলাটি খেলতেন। এমনকি পুনের নামের সাথে মিলিয়ে ওই সময় খেলাটি পুনা বা পুনাহ নামেও পরিচিত ছিল। ১৮৭৩ সালে পুনেতেই এ খেলার প্রথম কিছু নিয়মকানুন তৈরি করা হয়।
ভারতবর্ষে নির্বাসিত ইংরেজরা তাদের অবসর সময় কাটানোর উদ্দেশেই মূলত দুইটি গেম, ব্যাটলডোর আর শাটলককের সমন্বয়ে ব্যাডমিন্টন সৃষ্টি করে। ব্যাডমিন্টন নামটি এসেছে গ্লুস্টারশায়ারে ডিউক অব বোফার্টের ব্যাডমিন্টন হাউজের নাম থেকে।
১৯৩৪ সালে যখন আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন গঠিত হয়, এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে ছিল ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস এবং নিউজিল্যান্ড। ভারত সেখানে যোগদান করে আরো বছর দুয়েক পর, ১৯৩৬ সালে।
শুরুতে মহারাষ্ট্রের একটি শহরের নামে নামাঙ্কিত একটি খেলা আজ বৈশ্বিক ক্রীড়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে, এবং বিশ্বের বাঘা বাঘা সব অ্যাথলেট এ খেলার মাধ্যমে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করছে, বিষয়গুলো ভাবতেই অবাক লাগে কিন্তু!
ক্যারম

ক্যারম; Image Source: Shutterstock
এই খুবই জনপ্রিয় পারিবারিক খেলাটির উৎপত্তি যে দক্ষিণ এশিয়াতেই, সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। এবং ইতিহাসবিদদের একটি বড় অংশ এর জন্মস্থান হিসেবে ভারতকেই বিবেচনা করে থাকেন।
উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে ভারতে এ খেলাটিকে এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো যে, বিভিন্ন রাজ্যেই একেবারে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ খেলাটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হতো। তাই এ কথা বলাই বাহুল্য যে, মূল জন্মস্থান যেখানেই হোক, খেলাটিকে প্রতিপালন করে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসতে ভারতের অবদানই সর্বাধিক।
১৯৫৮ সালের মধ্যেই ভারতে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ক্যারম ক্লাব ও ফেডারেশন গঠিত হয়ে যায়, যারা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পৃষ্ঠপোষকতা করত এবং আকর্ষণীয় পুরস্কারও দিত। ১৯৮৮ সালে চেন্নাইয়ে আসে আন্তর্জাতিক ক্যারম ফেডারেশন। ধীরে ধীরে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয় প্রবাসীদের হাত ধরে সেসব অঞ্চলেও ক্যারম খেলাটির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে।
Comments
0 comments