কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ দিনকে দিন বাড়ছে। আর সেই সাথে বাড়ছে এ নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তাও। খুব সহজ ব্যাপার! কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিবেশ, মানুষের জীবনপদ্ধতি – সবকিছুতেই প্রভাব ফেলছে। ফলে এর পরিমাণ বেড়ে গেলে সেটি যে মানুষের জন্য মোটেও কোনো ভালো ফলাফল নিয়ে আসবে না তা সহজেই অনুমেয়।
এই সমস্যাকে তাই কীভাবে কোনো ভালো সমাধানের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় সেটা নিয়েই বিজ্ঞানীরা কাজ করে চলেছেন সবসময়। সম্প্রতি এমনই এক পদ্ধতি খুঁজে বের করেছেন তারা। আর পদ্ধতিটি হলো কার্বন ডাইঅক্সাইডকে জ্বালানিতে রুপান্তরিত করা।

এই প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাই অক্সাইডকে পানির দ্রবণে ব্যবহার করার মাধ্যমে ১,০০০ ঘন্টার বেশি সময় ধরে জ্বালানি তৈরি করা সম্ভব; Image Source: fortunedotcom.files.wordpress.com
এক্ষেত্রে একটি নতুন হাইব্রিড পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, যেখানে সোডিয়াম ও কার্বন ডাই অক্সাইডকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ ও হাইড্রোজেন উৎপাদন করা হচ্ছে। যেটাকে সহজেই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। এই প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইডকে পানির দ্রবণে ব্যবহার করার মাধ্যমে ১,০০০ ঘন্টার বেশি সময় ধরে জ্বালানি তৈরি করা সম্ভব। এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটিও বেশ দ্রুতগতির। ৫০ শতাংশ পর্যায়ে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া সবচাইতে কার্যকরী। নতুন এই প্রযুক্তিটি নিয়ে বিজ্ঞানীরাও অসম্ভব আশাবাদী।
ইউএনআইএসটি এর সিনিয়র লেখক অধ্যাপক গানটে কিম বলেন, “কার্বন জমা করা, সেটার ব্যবহার করা এবং স্বতন্ত্র করার প্রযুক্তি (সিসিইউএস) ইদানিংকালে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর একটি উপায় হিসেবে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।”
তিনি জানান যে, এই প্রক্রিয়ার মোদ্দা কথাটিই হলো কার্বন ডাই অক্সাইডের অণুগুলোকে অন্য উপাদানে পরিবর্তিত করা। নতুন এই প্রক্রিয়াটি পুরো ব্যাপারটিই কার্বন ডাই অক্সাইড ডিসলিউশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে করতে সক্ষম বলে জানান তিনি।
এই নতুন আবিষ্কারের জন্য আন্তর্জাতিক গবেষণাকারী দল সমুদ্রের সাহায্য নিয়েছেন। মানুষ যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরিত করে তার খুব বড় একটি অংশ সমুদ্র চলে যায় এবং এসিডে পরিণত হয়। এই এসিডের পরিমাণ আরো বাড়লে তা থেকে খুব সহজেই বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব। আর গবেষকেরা এই চিন্তাটিকে মাথায় রেখেই কাজে হাত দেন।
তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত নিজেদের কাজে সফল হয়েছেন তারা। এতদিন শুধু ধারণা হিসেবে থেকে গেলেও এখন ঠিক কীভাবে কাজটি করতে হবে সেই পদ্ধতিটাও জানেন গবেষকেরা।

এই প্রক্রিয়ার মোদ্দা কথাটিই হলো কার্বন ডাই অক্সাইডের অণুগুলোকে অন্য উপাদানে পরিবর্তিত করা; Image Source: d1w9csuen3k837.cloudfront.net
এই প্রযুক্তিতে আরো অনেক জ্বালানি পদ্ধতির মতোই মজুদ আছে একটি অ্যানোড, একটি ক্যাথোড এবং একটি সেপারেটর। এক্ষেত্রে কার্বন ডাই অক্সাইডকে পানির দ্রবণে প্রবেশ করানো হবে। আর সেখান থেকে তৈরি হবে ইলেকট্রোকেমিক্যাল রিঅ্যাকশন। এই রিঅ্যাকশন কার্বন ডাই অক্সাইডকে দূরে সরিয়ে পানির দ্রবণটিকে সোডিয়াম বাইকার্বনেটে পরিণত করবে। যেটাকে আমরা সোডা বলেই সাধারণত চিনি।
গবেষকদের মতে, এই প্রক্রিয়ায় শুধু কার্বন ডাই অক্সাইডই ব্যবহৃত হবে তা নয়, একই সাথে আমাদের পরিবেশ আরো পরিষ্কার হয়ে উঠতে এবং হাইড্রোজেনের উৎস তৈরি করতে সাহায্য করবে। ভবিষ্যতে এই পদ্ধতিটি আমাদের পরিবেশের জন্য অসম্ভব ভালো কাজ করবে বলে মনে করেন তারা। তবে আরো অনেক বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহার করতে পারলে সেক্ষেত্রে ফলাফল আরো ভালো হতে পারে বলে তাদের ধারণা।

সূর্যের আলো ব্যবহার করে কার্বন ডাইঅক্সাইডকে সিনগ্যাস বা মিথানলে পরিণত করা সম্ভব; Image Source: i.ytimg.com
এটি কার্বন ডাইঅক্সাইডকে সমুদ্রের পানিতে ব্যবহার করার মাধ্যমে পরিবেশ আরো সুন্দর হ্যে উঠবে। এদিক থেকে ব্যাপারটি নতুন। তবে কার্বন ডাই অক্সাইডকে জ্বালানিতে পরিণত করার এই চিন্তা এই প্রথম নয়। তবে এর আগে সমুদ্রের পানির কথা ভাবা হয়নি।
কিছুদিন আগেই কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্টার্টআপে ঠিক এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করা হয় যেটার মাধ্যমে সূর্যের আলো ব্যবহার করে কার্বন ডাই অক্সাইডকে সিনগ্যাস বা মিথানলে পরিণত করা সম্ভব করা হয়। এই জ্বালানিকে পরিবেশের জন্য যথেষ্ট উপকারি বলে ঘোষণা দেন বিজ্ঞানীরা।
যানবাহন, শক্তি, উষ্ণতা ও রান্নার জন্য এই পদ্ধতি যথেষ্ট কার্যকর। এই পুরো প্রক্রিয়াটির উপরে এখনো ডাইমেনশনাল এনার্জি নামক এই সংস্থাটি কাজ করে চলেছে। তাদের কাজটির নাম দেওয়া হয়েছে রিভার্স কমবাসশন প্রসেস (Reverse Combustion Process)। যাকে অন্য ভাষায় আর্টিফিশিয়াল ফটোসিন্থেসিসও বলা যায়।
সমুদ্রকে ব্যবহারের পদ্ধতিটি এখনো বেশ পিছিয়ে থাকলেও সূর্য ব্যবহার করে কার্বনকে জ্বালানিতে পরিণত করার এই প্রক্রিয়াটি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যেই নিজেদের কাজের ফলাফল নিয়ে বাজারে আসবে কোম্পানিটি এমনটাই আশা করা হচ্ছে।

সূর্য ব্যবহার করে কার্বনকে জ্বালানিতে পরিণত করার এই প্রক্রিয়াটি ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে; Image Source: www.sciencemag.org
এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে বর্ণনা করতে গিয়ে গবেষকেরা জানান যে, এক্ষেত্রে সবচাইতে বড় ভূমিকাটি পালন করছে সূর্যের আলো। তাদের মতে, শিল্প কারখানায় উৎপাদিত কার্বন ডাই অক্সাইডকে যদি বাইরে বের হতে না দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে এটি বাইরের পরিবেশকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারবে না। সেখান থেকেই কার্বনকে আলাদা করে নিয়ে রিঅ্যাক্টরে প্রবেশ করানো হবে।
তারপর এর সাথে হাইড্রোজেন ও খানিকটা সূর্যের রশ্মি মিশিয়ে দেওয়া হবে। সবকিছু ঠিকঠাক চললে এই কাজটি নিয়ম মেনে করলেই জ্বালানি উৎপন্ন করে। অন্যদিকে, আইসল্যান্ডে কার্বন ডাই অক্সাইডের সাথে খানিকটা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে জ্বালানি উৎপন্ন করা হচ্ছে। যেটি মিথানলে রুপান্তরিত হচ্ছে এবং ইউরোপে বিক্রির জন্য চলে যাচ্ছে।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা নিজেদের অবস্থান থেকে যতটা সম্ভব কার্বন নিঃসরণকে মাথায় রেখে কাজ করা শুরু করেছেন। ঠিক কতটা কাজে আসবে তাদের এই আবিষ্কারগুলো, কোন পদ্ধতিটি আগে ও বেশি কাজ করবে – এসব জানতে অবশ্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
Comments
0 comments