ধারাবাহিকভাবে আপনাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে বিশ্ব ইতিহাসের চরম নিন্দিত ক্রুসেড তথা ধর্মযুদ্ধের কাহিনী। বিগত পর্বে উল্লেখ করা হয়েছিল তৃতীয় থেকে সপ্তম ক্রুসেড, চিলড্রেন’স ক্রুসেড এবং কনস্টান্টিনোপলের পতন সম্পর্কে।
আজ ধারাবাহিকের চতুর্থ ও শেষ পর্বে তুলে ধরা হবে মামলুকদের উত্থান থেকে ক্রুসেডের সমাপ্তি সম্পর্কে, এছাড়াও কীভাবে এ ক্রুসেড ইতিহাসকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি আজকের দিনেও বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে উসকে দিতে এবং মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা বিশ্বকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করাতে প্রধান ভূমিকা পালন করছে।
মামলুকদের উত্থান
ক্রুসেডাররা যখন একের পর এক পরাজয় বরণ করে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল, ঠিক তখনই উত্থান ঘটে মামলুকদের। তাদের আগমন ঘটেছিল ইসলামিক সাম্রাজ্যের সাবেক দাস শ্রেণী থেকে। মিশরের ক্ষমতা দখল করে তারা। ১২৬০ সালে মামলুকরা ফিলিস্তিনে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে ধেয়ে আসা মঙ্গলদের রুখে দিতে সমর্থ হয়। মঙ্গলরা ছিল এ অঞ্চলে খ্রিস্টানদের বড় একটি মিত্রপক্ষ।

মামলুক সৈন্যবাহিনী; Image Source: Wikimedia Commons
দুর্ধর্ষ সুলতান বায়বারের অধীনে, ১২৬৮ সালে এন্টিওকে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় মামলুকরা। এর জবাবে, ১২৭০ সালে রাজা নবম লুই অষ্টম ক্রুসেড শুরু করেন। এ ক্রুসেডের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সিরিয়ায় অবশিষ্ট ক্রুসেডার রাজ্যগুলোকে সাহায্য করা। কিন্তু লুইয়ের মৃত্যুর পর সে অভিযান গতিপথ পরিবর্তন করে লুইয়ের মৃত্যুস্থল, উত্তর আফ্রিকার টিউনিসে পৌঁছায়।
১২৭১ সালে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ড নতুন আরেকটি যুদ্ধ অভিযান শুরু করেন। এই যুদ্ধটিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অষ্টম ক্রুসেডের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে অনেকে আবার এটিকে একদম পৃথক একটি ক্রুসেড, অর্থাৎ নবম ক্রুসেড হিসেবেও অভিহিত করে থাকে। এ ক্রুসেড থেকেও খ্রিস্টানদের অর্জন ছিল খুবই সামান্য, এবং এটিকেই ধরা হয়ে থাকে পবিত্র ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে সংগঠিত সর্বশেষ বড় কোনো ধর্মযুদ্ধ হিসেবে।
ক্রুসেডের সমাপ্তি
১২৮১ সালে নতুন মামলুক সুলতান কালাওয়ান মঙ্গলদের সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। ১২৯০ সালে ক্রুসেডার রাজ্যসমূহের শেষ অবস্থানগুলো রক্ষার জন্য ভেনিস ও আরাগন থেকে এক বিশাল নৌবাহিনীর আগমন ঘটে। পরের বছর সুলতান কালাওয়ানের ছেলে আল আশরাফ খলিল এক বিশাল বাহিনী নিয়ে ভূমধ্যসাগর উপকূলে ক্রুসেডারদের দীর্ঘদিনের শক্ত ঘাঁটি আক্রে বন্দর আক্রমণ করেন। এর মাধ্যমেই সমাপ্তি ঘটে ক্রুসেডের।

আক্রেতেই সমাপ্তি ঘটে ক্রুসেডের; Image Source: ThoughtCo
অবশ্য এত সহজেই হার মানতে নারাজ ছিল চার্চ। ১২৯১ সালের পরও তারা ছোট ছোট ক্রুসেড পরিচালনা করতে থাকে, যদিও সেগুলোতে তাদের লক্ষ্য ছিল খুবই সীমিত – প্রধানত তাদের অর্জিত রাজ্যগুলো থেকে মুসলিমদের বিতাড়িত করা কিংবা নতুন প্যাগান অঞ্চল দখল করা। কিন্তু ষোড়শ শতকে চার্চ এসব অভিযানের পৃষ্ঠপোষকতাও বন্ধ করে দেয়।
ক্রুসেডের প্রভাব
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ক্রুসেডের মাধ্যমে ইউরোপিয়ানদের কেবল পরাজয়ই হয়েছে, মোটের উপর খুব বড় কোনো অর্জন তাদের সাফল্যের খাতায় যুক্ত হয়নি। কিন্তু আবার অনেকেরই বিশ্বাস, ক্রুসেডের ফলাফল ও প্রভাব ছিল ব্যাপক ও সুবিস্তৃত।

ক্রুসেডের প্রভাব ছিল ব্যাপক; Image Source: Reference
ক্রুসেডের মাধ্যমেই খ্রিস্টান ধর্ম এবং পশ্চিমা সভ্যতা পূর্বাপেক্ষা অনেক বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। এছাড়া ক্রুসেডের মাধ্যমে বিশেষ লাভবান হয় রোমান ক্যাথলিক চার্চও, এবং তা সরাসরি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। ক্রুসেডের ফলে চার্চের সম্পদের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়, এবং ক্রুসেড শেষ হওয়ার পর পোপের ক্ষমতারও বৃদ্ধি ঘটে।
ক্রুসেডের ফলে সমগ্র ইউরোপজুড়ে বাণিজ্য ও পরিবহণ ব্যবস্থারও প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। যুদ্ধের কারণে খাদ্য, অস্ত্র ও পরিবহণের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং তার ফলে জাহাজ নির্মাণসহ অন্যান্য বিভিন্ন উৎপাদন শিল্পের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।
ক্রুসেডের পর আর দুইটি খাতে বিশেষ উপকার হয় ইউরোপের। তা হলো ভ্রমণ ও শিক্ষা। যুদ্ধযাত্রা করতে গিয়ে ইউরোপিয়ানরা নতুন নতুন দেশে পা রাখতে থাকে, নতুন নতুন জ্ঞানের সান্নিধ্যও লাভ করে। এর মাধ্যমে পুরো ইউরোপে যেমন মানুষের মধ্যে ভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়, তেমনই জ্ঞান অন্বেষণের প্রতিও অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় তাদের আগ্রহের মাত্রা বেড়ে যায়। অনেক ইতিহাসবিদই ধারণা করেন, ভ্রমণ ও শিক্ষার প্রতি ইউরোপিয়ানদের এই নব উদ্ভূত অনুরাগই রেনেসাঁর জন্ম দেয়।

ইউরোপীয় নবজাগরণে ভূমিকা ছিল ক্রুসেডের; Image Source: Wikimedia Commons
তবে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই ক্রুসেড একটি চরম নিন্দিত ঘটনা। তারা এটিকে অনৈতিক, রক্ষক্ষয়ী ও বর্বর হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। পবিত্র ভূমি পুনরুদ্ধারের নামে খ্রিস্টানরা যেভাবে মুসলিম, ইহুদি ও অখ্রিস্টানদের নিধন করে, তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মনে খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের যোগান দেয়।
এমনকি আজকের দিনেও, অনেক মুসলিমই মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বিশ্বের আক্রমণ কিংবা হস্তক্ষেপকে ক্রুসেডের সাথে তুলনা করে থাকে। তাদের মতে, একাদশ শতকে শুরু হওয়া ক্রুসেড এখনো শেষ হয়নি, বরং অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সেটির তীব্রতা ও মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, ক্রুসেড মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে যে শত্রুতার বীজ বপন করে দিয়েছিল, কালের প্রবাহে আজ তা মহীরুহে পরিণত হয়েছে। মুসলিমরা আজও খ্রিস্টানদের ক্ষমা করতে পারেনি। বরং অনেক গোঁড়া, চরম মনোভাবাপন্ন মুসলিম পরিবারে এখনো শিশুদের মনে সেই শৈশব থেকেই পশ্চিমাবিরোধী চেতনার লালন করা হতে থাকে। ফলে এই শিশুরা বড় হয়ে চরম পশ্চিমাবিদ্বেষী হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে অনেক গোঁড়া, ধর্মান্ধ খ্রিস্টানও কিন্তু ক্রুসেডে মুসলিমদের কাছে হারের লজ্জা ও হতাশা ভুলতে পারেনি। তাই তারাও মুসলিমদেরকে ঘৃণা করে, এবং সাম্প্রতিক বিশ্বের যেকোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দায়ই মুসলিমদের কাঁধে চাপিয়ে দিতে চায়।

মুসলিমদের কাছে ক্রুসেড এক চরম নিন্দিত ঘটনা; Image Source: Al Jazeera
শেষ কথা
মোদ্দা কথা হলো, মুসলিম ও খ্রিস্টানরা যে একে অপরের বিরোধী, তার প্রধান উৎস যতটা না ধর্মীয়, তারচেয়ে বেশি ধর্মের নামে হওয়া ক্রুসেড। সুতরাং এ দাবি করা যেতেই পারে যে, বর্তমান বিশ্বে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের যে অফুরন্ত যুদ্ধ, হানাহানি এবং রাজনৈতিক দ্বৈরথ দেখা যায়, তার মূলে রয়েছে ক্রুসেডই। প্রায় সাড়ে সাতশো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও, বিশ্বের প্রধান দুইটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে ভিন্নতা দেখা যায়, তা ক্রুসেডের প্রভাবেই।
Comments
0 comments