কলেজ স্ট্রিট মানে কি শুধুই বই? একদমই না। এর পরতে পরতে রয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা ইতিহাস, এবং ভারতীয় রাজনীতির বাঁক বদলের আখ্যান। জেনে হয়তো অবাক হবেন, ১৮৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই কলেজ স্ট্রিটেরই আলবার্ট হলে। সেই অধিবেশনকে বিবেচনা করা হয় “জাতীয় কংগ্রেসের মহড়া,” কেননা এই অধিবেশনের সূত্র ধরেই ১৮৮৫ সালে তৎকালীন বোম্বে শহরে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।

১৯২০ থেকে ‘৪০-এর দশক পর্যন্ত যখন ভারতীয় রাজনীতির এক অগ্নিগর্ভ সময়, তখন কলেজ স্ট্রিট পালন করছিল বিশেষ ভূমিকা। একে তো এটি তখন কলকাতার বৃহত্তম বইয়ের বাজার হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছে, অন্যদিকে এই কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে বসেই দেশাত্মবোধক চেতনায় দীক্ষিত হচ্ছে বাংলার রক্ত টগবগ করা উদ্যমী তরুণেরা। সেই সময় কফি হাউসে ঢুঁ মারলে প্রায়ই দেখা যেত স্বপ্নালু চোখের একটি ছেলেকে। টেবিলে বসে, ইনফিউশনে চুমুক দিতে দিতে সহ-বিপ্লবীদের বোঝাত সে, কীভাবে সশস্ত্র পথেই পরাধীনতার নিগড় ভাঙতে হবে, দেশ থেকে তাড়াতে হবে ব্রিটিশদের। ছেলেটির নাম সুভাষ চন্দ্র বসু।
আবার নকশাল আন্দোলনেরও আঁতুড়ঘর এই কলেজ স্ট্রিটই। যেহেতু নকশাল আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত তরুণেরা, তাই বলাই বাহুল্য তাদের অনেকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্র ছিল এই কলেজ স্ট্রিটেরই নানা কলেজ। তবে কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের উপর তারা কখনো আঘাত হানেনি। কারণ বইয়ের সাথে যে তাদের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। বরং এই কলেজ স্ট্রিটই তখন বিশেষ খ্যাতি কুড়িয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়া নিয়ে অসংখ্য বই প্রকাশ করে।

কলেজ স্ট্রিটের গৌরবময় ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো আড্ডা। এক সময় অগণিত আড্ডা বসত এখানে। এক একটি বইয়ের প্রকাশনীতে, বিক্রয় কেন্দ্রে, কিংবা কেবিন-কফি হাউসগুলোতে। দিলখুশা কেবিনের পাশের রাস্তায় দেবী সেনের নিজের দোকানে বসত একটি আড্ডা, যার মধ্যমণি ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যে অসম্ভব দক্ষ দেবীবাবু নিজেই।
প্রেমেন্দ্র মিত্রও অনেকবার হাজিরা দিয়েছেন এখানে। আবার বসন্ত কেবিনের আড্ডায় নিয়মিত উপস্থিতি ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়দের। দর্শক পত্রিকার ছোট্ট দোকানটিতে আড্ডা দিতে আসতেন সত্যজিৎ রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্ররা। সাথে পত্রিকার সম্পাদক দেবকুমার বসু তো ছিলেনই। এদিকে সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিনের দোকানটিরও বিশেষ পরিচিতি ছিল আড্ডার ঠেক হিসেবে।

তবে কলেজ স্ট্রিটের জনপ্রিয়তম, এবং সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আড্ডার কেন্দ্রস্থলটি অতি অবশ্যই কফি হাউস। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, মান্না দে’র কণ্ঠে অমরত্ব পাওয়া “কফি হাউসের সেই আড্ডাটা…” গানের সেই কফি হাউস। কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’-এ অনেকটা জীবন্ত চরিত্র হয়ে ওঠা সেই কফি হাউস। এক কথায় বলতে গেলে, বাঙালি সেমি-ইন্টেলেকচুয়ালদের প্রাণের কফি হাউস।
নিকটস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের তো বটেই, পাশাপাশি এই কফি হাউসের ছিল তৎকালীন লেখক, সাহিত্যিক, গায়ক, রাজনীতিবিদ, পেশাদার, ব্যবসায়ী ও বিদেশি পর্যটকদেরও আড্ডা দেওয়ার অবারিত পীঠস্থান হিসেবে খ্যাতি। সব মিলিয়ে এ যেন ছিল বুদ্ধিজীবীদের প্রাত্যহিক মিলনমেলা।
আরেকটু সহজ করে দিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য টিএসসি-ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া, স্বপন মামার চায়ের দোকান কিংবা মধুর ক্যান্টিন যেমন, তৎকালীন কলকাতার শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, সৃষ্টিশীল ও স্বপ্নচারী মানুষদের জন্য ঠিক তেমনটিই ছিল এই কফি হাউস। কে আসেননি এখানে!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু থেকে শুরু করে সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেন, মৃণাল সেন কিংবা ঋত্বিক ঘটক, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় — পশ্চিম বাংলার শিক্ষিত মানুষদের কাছে প্রবাদপ্রতিম পুরুষ ছিলেন যারা, তাদের প্রায় সকলেরই পা পড়েছিল এই কফি হাউসে। আড্ডা দিতেন তারা। তুলতেন চায়ের কাপে ঝড়। জন্ম দিতেন নিত্যনতুন সব জীবনাদর্শ ও দর্শনের। আর নিজেদের অজান্তেই রচনা করতেন বাংলার অনাগত ভবিষ্যতের ইতিহাস।

বাংলার ১৮৭৬ পরবর্তী উত্থান-পতন, আবর্তন-প্রত্যাবর্তনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে কলেজ স্ট্রিটস্থ এই কফি হাউসের নাম। কিন্তু কীভাবে সূচনা ঘটেছিল এই কফি হাউসের? তা জানতে আমাদেরকে সময় পরিভ্রমণের মাধ্যমে ফিরে যেতে হবে ১৮৭৬ সালে, যখন প্রিন্স আলবার্টের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় আলবার্ট হল। তার আগ পর্যন্ত বাড়িটি ছিল বাঙালি দার্শনিক কেশব চন্দ্র সেনের বসতবাড়ি।
ভারতের কফি বোর্ডের নির্দেশে ১৯৪২ সালে প্রথম এই কফি হাউসে শুরু হয় কফি বিক্রি। ১৯৪৭ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক এই কফি দোকানের পরিবর্তিত নাম হয় কফি হাউস। তারপর থেকে কফি হাউসটি ইতিহাসের অংশ হিসেবে পার করে এসেছে বহু চড়াই-উৎরাই, সীমাহীন ঘাত-প্রতিঘাত। চলার পথ মসৃণ ছিল না কখনোই, তবে একবার হয়ে পড়েছিল পুরোদস্তুর কণ্টকময়।
সেটি ১৯৫৮ সালের কথা, যখন কর্তৃপক্ষের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তে তালা ঝোলে কফি হাউসের দরজায়। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকেরা এই কফি হাউস খোলার দাবি তুললে ওই বছরই ফের চালু হয় কফি হাউসটি। ২০০৬ সালে আরেক দফা পরিবর্তন আসে সমবায় সমিতির হাত ধরে, যারা কফি হাউসটির নতুন নাম দেয় ইন্ডিয়ান কফি হাউস।
বাঙালির স্মৃতিমেদুর মননে আগুনের সলতে দেয়ার মতো প্রধান গান রয়েছে দুইটি। একটি যদি হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “পুরানো সেই দিনের কথা,” অন্যটি অবশ্যই মান্না দে-র “কফি হাউসের সেই আড্ডাটা”। কিন্তু আসলেই কি কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই? আপনি যদি নিজে পা রাখেন এই কফি হাউসে, তবে দ্বিমত পোষণে বাধ্য হবেন। যুক্তিবিদ্যাই বলে, বাঙালির আড্ডা কখনো শেষ হবার নয়। আর কফি হাউসে পাওয়া যাবে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।
কফি হাউসের উপরে লম্বা করিডোর। সরু সেই করিডোরে এক লাইন করে টেবিল বসানো। সারাদিনই কেউ না কেউ দখল করে থাকে সেসব টেবিল। বড় টেবিলগুলোতে বসে দল বেঁধে আড্ডা দেয় বন্ধুরা। প্রেমিক যুগলের উৎপাতে খালি থাকে না ছোট টেবিলগুলোও। তাই তো খুব সৌভাগ্যবান না হলে ঢোকামাত্রই হাউসফুল কফি হাউসে বসার জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়।
তেলেভাজা, আদা-চা, কফি, চিকেন স্যান্ডউইচ, ফ্রাইড রাইস, নুডুলসসহ নানাবিধ খাবার ও পানীয়ের গন্ধে ম ম করবে পরিবেশ, খিদে চাগিয়ে উঠবে আপনার পেটের ভিতর। কিন্তু তবু বসার জায়গা পাওয়ার আগ পর্যন্ত দিতে হবে ধৈর্যের চরম পরীক্ষা।
কফি হাউসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হলো, এখানে কোনোরকম বিধিনিষেধের বালাই নেই। আপনি এক কাপ কফি নিয়ে বসে থাকতে চান ঘণ্টার পর ঘণ্টা? আড্ডা দিতে যান প্রাণ ভরে? চাইলেই সব পারবেন। কেউ এসে আপনাকে ভাগিয়ে দেবে না। এমনকি বাঁকা চোখেও তাকাবে না। বরং অতিথি সৎকারে সদা নিয়োজিত থাকেন এখানকার সাদা ইউনিফর্ম পরিহিত পরিপাটি ওয়েটাররা।
সব মিলিয়ে এখানে কাজ করা কর্মচারীর সংখ্যা ৮০ জন। দিনে গড়ে দেড় হাজার অতিথি সামলান তারা। তাই গানে যতই বলা হোক, কফি হাউসের আড্ডাটা আজ আর নেই, তা কিন্তু পুরোপুরি সত্যি নয়। এই কদিন আগে পর্যন্তও, অর্থাৎ করোনাকাল শুরুর পূর্বেও, সেই আড্ডা খুব ছিল! আরো ছিল সেই আড্ডার টেবিল, ধূমায়িত কফির পেয়ালা, ঐতিহাসিক সিঁড়ি, সিঁড়ির দুপাশে বন্দি মুক্তির দাবি কিংবা তরুণ কবির সংগ্রাম। এমনকি রাজনৈতিক পোস্টার, সাম্প্রতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদ কিংবা রক্তলাল পানের পিক, মজুদ ছিল সবকিছুই।
হয়তো নিখিলেশ, মইদুল, ডিসুজারা আর নেই, কিন্তু তাই বলে তাদের বসার আসন ফাঁকাও পড়ে ছিল না। সুযোগ বুঝে সেসব আসনে টুপ করে বসে পড়ত অন্য কোনো রমা, অমল কিংবা সুজাতা। যে কেউ চাইলেই দুদণ্ড বসে কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে আড্ডার ছলে রাজি-উজির মারতে কিংবা মমতা, মোদি থেকে শুরু করে ট্রাম্প সবাইকে ধুয়ে দিতে পারত এখানে, লিখতে পারত নতুন আগামীর ইতিহাস।
সাম্প্রতিক আমফানের আস্ফালন, কিংবা তারও আগে থেকে গোটা পৃথিবীকে থমকে দেয়া করোনার কারণে, কলেজ স্ট্রিট ও কফি হাউস হয়তো সাময়িকভাবে হারিয়েছে তাদের চিরচেনা প্রাণোচ্ছ্বাস। তবে একদিন নিশ্চয়ই আবার পৃথিবী ফিরবে তার ছুটে চলার আপন কক্ষপথে, আগের মতোই গতিশীল হবে সবকিছু। আশা করা যায়, সেদিন আবারো কলেজ স্ট্রিট ও কফি হাউজে নামবে আনন্দে উদ্বেল মানুষের ঢল। আর তাতে শামিল হতে পারেন আপনিও।
Comments
0 comments